নারী সম্পর্কিত ইসলাম ধর্মের প্রতিটি বিষয়ই শালীনতা ও হায়ার চারপাশে আবর্তিত। এই বিষয়েই ইসলাম নারীদেরকে তাদের ঘরের সীমানায় থাকার নির্দেশ দেয়, যাতে গাইর মাহরাম পুরুষদের দৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণরূপে আড়ালে থাকে এবং বৈধ শরয়ী প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হয়।’
যে পদ্ধতিতে একজন মহিলাকে তার নামাজ আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে – নামাজের জন্য তার পোশাক থেকে শুরু করে নামাজের সময় তার ভঙ্গি – সবই স্পষ্টভাবে গোপন করার দিকটির দিকে নির্দেশ করে।’
তাই, দ্বীনের অন্যান্য বিভিন্ন ইবাদতের কথা বাদ যাক, একজন নারীর নামাজ একাই একজন নারীর জন্য কতটা শালীনতা ও হায়া প্রদর্শনের প্রয়োজন তা বোঝায়। তাই, তাকে তার দ্বীন ও পার্থিব জীবনের অন্যান্য বিভাগে তার নামাজে যে শালীনতা এবং হায়া প্রদর্শন করে, সেই একই মাত্রা অবলম্বন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গোপনীয়তা
এটি একটি অবিসংবাদিত সত্য যে মহিলাদের শারীরিক গঠন পুরুষদের থেকে আলাদা। শরীয়ত এটাকে বিবেচনায় নিয়েছে এবং এভাবে দ্বীনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা বিধান নির্ধারণ করেছে।’
মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র বিধানের অন্তর্নিহিত কারণ হল যে তাদের সবকিছু এমনভাবে করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যা তাদের জন্য আরও লুকায়িত হয়। এই পার্থক্যটি নামাজের বিভিন্ন ভঙ্গিতেও বিবেচনা করা হয়েছে। একজন মহিলাকে তার ভঙ্গি এমনভাবে আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয় যা সবচেয়ে কম প্রকাশ করে এবং সবচেয়ে গোপন করে।’
ইমাম বায়হাকী রহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেছেন:
وجماع ما يفارق المرأة فيه الرجل من أحكام الصلاة راجع إلى الستر وهو أنها مأمورة بكل ما كان أستر لها (السنن الكبرى للبيهقي، الرقم: 3196)
একজন নারীর নামাজের সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন দিক যা একজন পুরুষের নামাজের (অর্থাৎ নামাজের বিভিন্ন ভঙ্গি আদায় করার পদ্ধতি) থেকে আলাদা সবই সতরের (গোপনীয়তা) উপর ভিত্তি করে। একজন মহিলাকে তার নামাজের প্রতিটি ভঙ্গি এমনভাবে আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে তার শরীরের আকৃতি এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সবচেয়ে বেশি লুকিয়ে থাকে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাদ্বীয়াল্লাহু আনহু) বলেন, হযরত রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম)-এর যুগে নামাজ আদায়ের সময় নারীদেরকে নির্দেশ দেওয়া হতো যেন তারা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যথাসম্ভব কাছাকাছি রাখে।[1]
চার মাযহাব
হযরত রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম), সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বীয়াল্লাহু আনহুম), তাবিঈন (রহিমাহুল্লাহ) এবং পরবর্তী শতাব্দীর পর থেকে নারীদেরকে এমনভাবে নামাজ আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যা কিছু দিক থেকে পুরুষদের নামাজের থেকে ভিন্ন ছিল। চারটি মাযহাব (যেমন হানাফী, মালিকি, শাফেঈ ও হাম্বলী মাযহাব) সকলেই একমত যে নারীদের নামায পুরুষদের নামায থেকে কিছু দিক দিয়ে আলাদা।[2]
মহিলাদের ঘরের সীমানায় নামায আদায় করার ব্যাপারে হযরত রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) এর ইচ্ছা
যেখানে হযরত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জ্বলন্ত ইচ্ছা ছিল যে তাঁর উম্মতের পুরুষরা মসজিদে জামাআতের সাথে তাদের নামাজ আদায় করবে, সেখানে তাঁর হৃদয়ের ইচ্ছা ছিল যে তাঁর উম্মতের মহিলারা তাদের ঘরের মধ্যেই তাদের নামাজ আদায় করবে।’
হযরত রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) নারীদেরকে তাদের ঘরে নামাজ আদায় করতে এবং পুরুষদের দৃষ্টির আড়ালে থাকতে উৎসাহিত করেছেন, এত পরিমাণে যে, তিনি বলেছেন, “কোন মহিলার শোবার ঘরের নামাজ, তার বাড়ির ঘেরা উঠানে তার নামাজের চেয়ে বেশি সওয়াবপূর্ণ এবং শোবার ঘরের ভিতরের অংশে (শোবার ঘরের মধ্যে একটি ছোট ঘর) তার নামাজ তার শোবার ঘরে নামাজের চেয়ে বেশি সওয়াবপূর্ণ।”[3]
একবার হযরত আবু হুমাইদ আস-সাঈদী (রাদ্বীয়াল্লাহু আনহু)-এর স্ত্রী হযরত উম্মু হুমাইদ (রাদ্বীয়াল্লাহু আনহা) হযরত রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম)-এর কাছে এসে বললেন, হে রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম), আমি আপনার পেছনে নামাজ আদায় করতে চাই। হযরত রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) উত্তরে বললেন, আমি অবগত যে, তুমি আমার পেছনে নামাজ আদায় করতে ইচ্ছুক। কিন্তু, তোমার শোবার ঘরে তোমার নামাজ তোমার বাড়ির অন্য যেকোনো অংশে নামাজের চেয়ে বেশি সওয়াবপূর্ণ। তোমার বাড়ির অন্য যে কোনো অংশের নামাজ তোমার ঘেরা উঠানের নামাজের চেয়ে বেশি সওয়াবপূর্ণ। তোমার ঘেরা উঠানের নামাজ তোমার এলাকার মসজিদে নামাজের চেয়েও বেশি সওয়াবের কাজ। আমার মসজিদে (মসজিদে নববী) নামাজের চেয়ে তোমার এলাকার মসজিদে নামাজ বেশি সওয়াবপূর্ণ। হরত উম্মু হুমাইদ রাদ্বীয়াল্লাহু আনহা (হযরত রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম মুবারক ইচ্ছা মেনে ও আনুগত্য করে) নির্দেশ দিয়েছিলেন যে তাঁর শোবার ঘরের অভ্যন্তরীণ অংশে তাঁর নামাজের জন্য একটি ছোট জায়গা সংরক্ষিত থাকবে এবং তিনি নিষ্ঠার সাথে সেই জায়গাটায় তাঁর জীবনের শেষ অবধি তাঁর সমস্ত নামাজ আদায় করবেন।[4]
হযরত ইমাম শাফেঈ (রহিমাহুল্লাহ) এর বক্তব্য
হযরত ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ ইখতিলাফুল হাদীসে লিখেছেনঃ
হযরত রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসল্লাম) -এর সম্মানিত স্ত্রীদের মধ্যে কেউ জুমুআর নামাজে বা মসজিদে অন্য কোন নামাজে অংশগ্রহন করার জন্য ঘর ছেড়েছেন বলে আমরা জানি না, যদিও হযরত রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) এর সম্মানিত স্ত্রীগণ তাঁদের বিশেষ অবস্থান, এবং হযরত রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) এর সাথে সম্পর্কের কারণে, মসজিদে ফরজ নামাজ আদায় করার জন্য যে কোনও মহিলার চেয়ে বেশি ন্যায্য এবং যোগ্য হত, তবুও তাঁরা তা করেনি।
হযরত রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ঘনিষ্ঠ মহিলা, তাঁর সম্মানিত স্ত্রী, কন্যা, তাঁর দাসী এবং তাঁর গৃহের দাসীদের মধ্যে এমন অনেক মহিলা ছিলেন, তবুও আমার জানা নেই, তাদের মধ্য থেকে এবংকি একজন মহিলা যিনি হযরত রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসল্লাম) এর পিছনে জুমুআর নামাজে যোগদানের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন, যদিও অন্যান্য সকল নামাজের চেয়ে জুমুআর নামাজ পুরুষদের উপর বড় ফরয হওয়া সত্ত্বেও। একইভাবে, আমাদের জানা নেই যে তাদের কেউ জামাতে শরীক হওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়, না রাতের বেলায় না দিনে, এমনকি তারা কুবার মসজিদেও যায় নি, যদিও হযরত রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) কুবায় যেতেন, কখনো তার সাওয়ারিতে চড়ে কখনো পায়ে হেঁটে, এবং তারা অন্য কোন মসজিদেও যাননি। আমার সন্দেহ নেই যে, হযরত রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম)-এর সঙ্গে তাঁদের বিশেষ সম্পর্কের কারণে তাঁরা পুণ্য ও সওয়াব অর্জনের জন্য আগ্রহী ছিলেন এবং তাঁরা অন্যান্য নারীদের তুলনায় সওয়াব অর্জনের পথ ভালোভাবে জানতেন, তবুও তাঁরা নামাজের জন্য মসজিদে যাননি।
আমার জানা নেই যে আমাদের পূর্বসূরিদের মধ্যে কোন ধার্মিক ব্যক্তি তাঁদের নারীদের কাউকে জুমুআর নামাজে বা জামাতের নামাজে, না রাতে বা দিনের বেলায় অংশ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। যদি তাঁরা জানত যে, নারীদের ঘর থেকে বের হওয়া এবং জামাতে নামাজে অংশ নেওয়ার মধ্যে কোন ফজিলত আছে, তাহলে তাঁরা অবশ্যই তাদের নির্দেশ দিতেন এবং তাদের তা করার অনুমতি দিতেন। বরং বর্ণিত রয়েছে যে, হযরত রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) বলেছেন, “একজন মহিলার তার শয়নকক্ষে নামাজ তার বাড়ির অন্য সাধারণ কক্ষের নামাজের চেয়ে উত্তম এবং তার ঘরের সাধারণ কক্ষে তার নামাজ মসজিদে তার নামাজের চেয়ে উত্তম।”[5]
[1] عن نافع عن ابن عمر رضي الله عنهما أنه سئل كيف كن النساء يصلين على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم كن يتربعن ثم أمرن أن يحتفزن (مسند الإمام الأعظم للحصكفي على ترتيب السندي صـ 73)
(عن نافع عن ابن عمر أنه سئل كيف كن النساء يصلين على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم) أي في زمانه صلى الله عليه وسلم (قال كن يتربعن) أي في حال قعودهن (ثم أمرن أن يحتفزن) بالحاء المهملة والفاء والزاء أي يضممن أعضاءهن بأن يتوركن في جلوسهن (شرح مسند الإمام أبي حنيفة للقاري صـ 191)
صححه العلامة ظفر أحمد العثماني في إعلاء السنن (3/27)
[2] المذهب الحنفي: ويجافي بطنه عن فخذيه كذا في الهداية والمرأة لا تجافي في ركوعها وسجودها وتقعد على رجليها وفي السجدة تفترش بطنها على فخذيها كذا في الخلاصة (الفتاوى الهندية 1/75)
المذهب المالكي: المرأة يندب كونها منضمة في ركوعها وسجودها (حاشية الدسوقي 1/249)
المذهب الشافعي: ولا فرق بين الرجال والنساء في عمل الصلاة إلا أن المرأة يستحب لها أن تضم بعضها إلى بعض وأن تلصق بطنها بفخذيها في السجود كأستر ما يكون وأحب ذلك لها في الركوع وفي جميع الصلاة وأن تكثف جلبابها وتجافيه راكعة وساجدة لئلا تصفها ثيابها وأن تخفض صوتها وان نابها شئ في صلاتها صفقت (المجموع شرح المهذب 3/346)
المذهب الحنبلي: تجمع نفسها في الركوع والسجود وسائر صلاتها (المغني لابن قدامة 1/339)
[3] عن عبد الله عن النبي صلى الله عليه وسلم قال صلاة المرأة في بيتها أفضل من صلاتها في حجرتها وصلاتها في مخدعها أفضل من صلاتها في بيتها (سنن أبي داود، الرقم: 570)
[4] عن عبد الله بن سويد الأنصاري عن عمته أم حميد امرأة أبي حميد الساعدي أنها جاءت النبي صلى الله عليه وسلم فقالت يا رسول الله إني أحب الصلاة معك قال قد علمت أنك تحبين الصلاة معي وصلاتك في بيتك خير من صلاتك في حجرتك وصلاتك في حجرتك خير من صلاتك في دارك وصلاتك في دارك خير من صلاتك في مسجد قومك وصلاتك في مسجد قومك خير من صلاتك في مسجدي قال فأمرت فبني لها مسجد في أقصى شيء من بيتها وأظلمه وكانت تصلي فيه حتى لقيت الله جل وعلا (صحيح ابن حبان، الرقم: 2217)
[5] ولم نعلم من أمهات المؤمنين امرأة خرجت إلى جمعة ولا جماعة في مسجد وأزواج رسول الله صلى الله عليه وسلم بمكانهن من رسول الله صلى الله عليه وسلم أولى بأداء الفرائض … وقد كان مع رسول الله صلى الله عليه وسلم نساء من أهل بيته وبناته وأزواجه ومولياته وخدمه وخدم أهل بيته فما علمت منهن امرأة خرجت إلى شهود جمعة والجمعة واجبة على الرجال بأكثر من وجوب الجماعة في الصلوات غيرها ولا إلى جماعة غيرها في ليل أو نهار ولا إلى مسجد قباء فقد كان النبي صلى الله عليه وسلم يأتيه راكبا وماشيا ولا إلى غيره من المساجد وما أشك أنهن كن على الخير بمكانهن من رسول الله صلى الله عليه وسلم أحرص وبه أعلم من غيرهن … وما علمت أحدا من سلف المسلمين أمر أحدا من نسائه بإتيان جمعة ولا جماعة من ليل ولا نهار ولو كان لهن في ذلك فضل أمروهن به وأذنوا لهن إليه بل قد روي والله أعلم عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال صلاة المرأة في بيتها خير من صلاتها في حجرتها وصلاتها في حجرتها خير من صلاتها في المسجد أو المساجد (اختلاف الحديث صـ 625-626)