ধার্মিক সন্তান—আখিরাতের জন্য এক মূল্যবান ‎বিনিয়োগ

আল্লাহ তা‘আলা মানুষের ওপর যে অমূল্য নিয়ামতসমূহ দান করেছেন, তার মধ্যে একটি বিশেষ নিয়ামত হলো সন্তান। সন্তান আল্লাহ তা‘আলার সেই বিশেষ অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত, যা কুরআন মাজীদে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَجَعَلَ لَكُم مِّنْ أَزْوَاجِكُم بَنِينَ وَحَفَدَةً وَرَزَقَكُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ

“আল্লাহ তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য স্ত্রীগণ সৃষ্টি করেছেন, এবং তোমাদের স্ত্রীদের মাধ্যমে তোমাদের জন্য পুত্র ও পৌত্রগণ সৃষ্টি করেছেন, এবং তোমাদেরকে উত্তম রিজিক দান করেছেন।”[1]

আল্লাহ তা‘আলার অনেক নিয়ামত এমন হয় যার উপকারিতা শুধু জীবদ্দশায় সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু সন্তান এমন এক নিয়ামত যা জীবিত অবস্থায় যেমন কল্যাণ বয়ে আনে, তেমনি মৃত্যুর পরও তা উপকার করে।

তবে এই বিনিয়োগ তখনই ফলদায়ক হবে, যখন একজন ব্যক্তি তার সন্তানদের মধ্যে দ্বীনি মূল্যবোধ সৃষ্টি করবেন এবং তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে সংযুক্ত করবেন। যতদিন সন্তানরা দ্বীনকে আঁকড়ে ধরবে এবং পিতা-মাতার শেখানো দ্বীনের শিক্ষা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করবে, ততদিন এই বিনিয়োগ তার জন্য কল্যাণ ও সওয়াবের কারণ হয়ে থাকবে—এবংকি মৃত্যুর পরও।

মানুষের মৃত্যুর পর সর্বোত্তম যে জিনিসটি রেখে যেতে পারে

রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) বলেছেন, “মানুষ তার মৃত্যুর পর সর্বোত্তম জিনিস যা রেখে যেতে পারে তা হল তিনটি; একজন ধার্মিক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করবে, সাদাকাতে জারিয়া (সেই ভালো ও সৎকর্ম – যার প্রতিদান মৃত্যুর পরেও ব্যাক্তি পেতে থাকে), এবং দ্বীনের জ্ঞান (যা সে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছিল) যা মানুষ তার মৃত্যুর পরেও অনুশীলন করে।”[2]

অন্য একটি হাদিসে, রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) বলেছেন, “কোন পিতা তার সন্তানকে সদাচারের চেয়ে উত্তম উপহার দিতে পারে না।”[3]

আরেকটি হাদিসে, রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) উল্লেখ করেছেন, “তোমাদের সন্তানদের সাথে সম্মান ও মর্যাদার সাথে আচরণ করো এবং তাদের ভালো নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষা দাও।”[4]

কুরআন মাজিদের নির্দেশ

সন্তানদের মধ্যে দ্বীনি মূল্যবোধের জন্ম দেওয়া পিতামাতার উপর এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজিদে এই দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا

হে ঈমানদারগণ! জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে এবং আপনার পরিবারকে বাঁচান…[5]

অন্য কথায়, আপনি আপনার স্ত্রী ও সন্তানদেরকে দ্বীনের দিকে পরিচালিত করুন এবং তাদেরকে গোমরাহীর পথে চলা থেকে রক্ষা করুন। অতএব, কিয়ামতের দিন, একজন ব্যক্তিকে এই কর্তব্য এবং দায়িত্ব সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা করা হবে।

প্রত্যেক পিতামাতা তার পালের জন্য দায়ী এবং জবাবদিহি করতে বাধ্য

রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) বলেছেন, “তোমাদের প্রত্যেকেই একজন রাখাল, এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার পাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। মুসলিম নেতা একজন রাখাল এবং তাকে তার প্রজাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, এবং একজন স্বামী একজন রাখাল যাকে তার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, এবং একজন স্ত্রী তার স্বামীর বাড়িতে একজন রাখাল এবং তাকে তার পাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে…”[6]

বিপরীতভাবে, যদি কোন ব্যক্তি তার সন্তানদের সঠিক ইসলামী লালন-পালন করতে অবহেলা করে, তাদের মধ্যে দ্বীনের মূল্যবোধ স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়, অথবা তারা যে সঙ্গ রাখে সে সম্পর্কে উদ্বিগ্ন না হয়, যার ফলে তারা ভুল উপাদানের সংস্পর্শে আসে, তাহলে তারা ফায়দা ও কল্যাণের মাধ্যম হওয়ার পরিবর্তে, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে তার জন্য বিপদে পরিণত হবে।

রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) ও নবী দাঊদ (আলাইহিস সালাম)এর দোয়া

বর্ণিত আছে যে, রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) উম্মতকে বিদ্রোহী সন্তানদের থেকে সুরক্ষার জন্য যে দোয়া করতে শিখিয়েছিলেন তার মধ্যে একটি নিম্নোক্ত দোয়া:

اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ جَارِ السُّوْءِ وَمِنْ زَوْجٍ تُشَيِّبُنِيْ قَبْلَ الْمَشِيْبِ وَمِنْ وَلَدٍ يَكُوْنُ عَلَيَّ رَبًّا

হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই একজন দুষ্ট প্রতিবেশী থেকে, এমন একজন স্ত্রীর কাছ থেকে যে আমার চুলকে বার্ধক্যের আগে সাদা করে দেবে এবং এমন একটি সন্তান থেকে যে আমার উপর কর্তৃত্ব করবে (যা আমাকে কষ্ট দেবে) ‎[7]

একইভাবে, নবী দাউদ (আলাইহিস সালাম) যে দোয়া করতেন তার মধ্যে রয়েছে: ‎

اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ مَّالٍ يَكُوْنُ عَلَيَّ فِتْنَةً وَمِنْ وَلَدٍ يَكُوْنُ عَلَيَّ وَبَالًا

হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এমন সম্পদ থেকে যা আমার জন্য ফিতনা (পরীক্ষা) এবং এমন সন্তান থেকে যা আমার জন্য বিপদ![8]

রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম) তাঁর মুবারক হাদীস এবং মহৎ আচরণের মাধ্যমে সাহাবাগণ এবং উম্মতকে তাদের সন্তানদের উত্তম নৈতিকতা ও দ্বীনের মূল্যবোধ শেখানোর এবং তাদের মধ্যে ইসলামী আদব স্থাপনের পদ্ধতি শিখিয়েছিলেন।


[1] سورة النحل: 72

[2] سنن ابن ماجة، الرقم: 241، وإسناده صحيح كما في الترغيب والترهيب للمنذري، الرقم: 125

[3] سنن الترمذي، الرقم: 1952، وقال الذهبي في المهذب في اختصار السنن الكبير، الرقم: 2044: رواه جماعة عن عامر قلت: هو ضعيف والخبر فمرسل

[4] سنن ابن ماجه، الرقم: 3671، وإسناده ضعيف كما في مصباح الزجاجة 4/102

[5] سورة التحريم: 6

[6] صحيح البخاري، الرقم: 893

[7] الدعاء للطبراني، الرقم: 1339، ورواته ثقات

[8] المعجم الأوسط، الرقم: 6180، وقال الهيثمي في مجمع الزوائد، الرقم: 17429 وفيه من لم أعرفهم

Check Also

হযরত আবদুল্লাহ বিন মারযুকে (রহিমাহুল্লাহ) এর ঘটনা

হযরত আবদুল্লাহ বিন মারযুক (রহিমাহুল্লাহ) ছিলেন আল্লাহর একজন ধার্মিক বান্দা এবং মহান মুহাদ্দিস হযরত সুফিয়ান …